আধুনিক জীবনযাত্রায় বেশিরভাগ মানুষই অফিসে বসে কাজ করেন, যা শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে এক জায়গায় বসে কাজ করলে পিঠে ব্যথা, ঘাড়ের জড়তা, চোখের ক্লান্তি, ওজন বৃদ্ধি, এবং মানসিক চাপের মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। অফিসে বসে কাজের কারণে শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য কিছু বিশেষ যত্ন ও অভ্যাস গড়ে তোলা খুবই জরুরি। আসুন জেনে নিই অফিসে বসে কাজের ফলে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যা প্রতিরোধে কার্যকর কিছু টিপস।
অফিসে বসে কাজের ফলে সৃষ্ট সাধারণ শারীরিক সমস্যা
১. পিঠে ব্যথা ও কোমরের সমস্যা: - দীর্ঘ সময় ধরে বসে কাজ করার ফলে পিঠ এবং কোমরের পেশি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ব্যথা হতে পারে।
২. ঘাড় ও কাঁধের জড়তা: - ডেস্কে কাজ করার সময় অনেকেই ভুল ভঙ্গিমায় বসে থাকেন, যার ফলে ঘাড় ও কাঁধের পেশি টান ধরে এবং জড়তা দেখা দেয়।
৩. চোখের ক্লান্তি ও শুষ্কতা: - কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকলে চোখের ক্লান্তি, জ্বালাপোড়া এবং শুষ্কতা দেখা দিতে পারে।
৪. ওজন বৃদ্ধি ও স্থূলতা: - নিয়মিত শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এবং দীর্ঘ সময় বসে কাজ করার ফলে ওজন বৃদ্ধি এবং স্থূলতার ঝুঁকি বাড়ে।
৫. মানসিক চাপ ও ক্লান্তি: - কাজের চাপ, দীর্ঘ সময় বসে থাকা এবং মানসিক উত্তেজনার ফলে মানসিক চাপ ও ক্লান্তি বাড়তে পারে।
শারীরিক সমস্যা প্রতিরোধে কার্যকর টিপস
১. সঠিক বসার ভঙ্গিমা মেনে চলুন
- পিঠ সোজা রেখে বসুন: চেয়ারে বসার সময় পিঠ সোজা রাখুন এবং কোমরের নিচের অংশকে চেয়ারের সাথে মিলিয়ে রাখুন। পায়ের নিচে মাটি স্পর্শ করাতে হবে, পা যেন ঝুলে না থাকে।
- মonitor চোখের সোজাসুজি রাখুন: কম্পিউটার স্ক্রিনটি এমন উচ্চতায় রাখুন যাতে এটি চোখের সরাসরি লেভেলে থাকে। স্ক্রিন খুব উপরে বা নিচে থাকলে ঘাড়ে চাপ পড়ে।
২. নিয়মিত বিরতি নিন
- বিরতি দেওয়ার গুরুত্ব: প্রতি ৩০ মিনিট পর পর কাজ থেকে বিরতি নিন। এতে পেশিগুলো শিথিল হবে এবং শরীরের রক্ত সঞ্চালন উন্নত হবে।
- হাঁটাহাঁটি করুন: বিরতির সময়ে অফিসের ভিতরে বা বাইরে হাঁটাহাঁটি করুন। এটি শরীরকে শিথিল করবে এবং মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে।
৩. চোখের যত্ন নিন
- ২০-২০-২০ নিয়ম অনুসরণ করুন: প্রতি ২০ মিনিট পর, ২০ সেকেন্ডের জন্য ২০ ফুট দূরের কোনো বস্তু দেখুন। এটি চোখের ক্লান্তি কমাবে এবং চোখের শুষ্কতা প্রতিরোধ করবে।
- স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা ঠিক রাখুন: কম্পিউটারের স্ক্রিনের উজ্জ্বলতা এমনভাবে সেট করুন যাতে এটি চোখের জন্য আরামদায়ক হয়।
৪. হালকা ব্যায়াম ও স্ট্রেচিং করুন
- নিয়মিত স্ট্রেচিং: দীর্ঘ সময় বসে থাকলে পিঠ, ঘাড়, কাঁধ এবং পায়ের পেশি টান ধরে। এর জন্য সময়ে সময়ে স্ট্রেচিং করা জরুরি। সহজ কিছু স্ট্রেচিং ব্যায়াম যেমন আর্ম স্ট্রেচ, নেক স্ট্রেচ, লেগ স্ট্রেচ আপনার প্রতিদিনের রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন।
- চেয়ারে বসে সহজ ব্যায়াম: আপনি যদি দীর্ঘ সময়ের জন্য বসে থাকেন, তাহলে বসে বসে কিছু সহজ ব্যায়াম করতে পারেন, যেমন: গোড়ালি উঁচু করা, হাতের আঙুল স্ট্রেচ করা এবং ঘাড়ের পেশি ঘোরানো।
৫. পর্যাপ্ত পানি পান করুন
- শরীরকে আর্দ্র রাখুন: দীর্ঘ সময় বসে কাজ করলে শরীরের জড়তা দূর করতে এবং সতেজ রাখতে পর্যাপ্ত পানি পান করা অত্যন্ত জরুরি।
- কফি বা চা পান নিয়ন্ত্রণ করুন: অতিরিক্ত কফি বা চা পান করলে শরীরের পানির পরিমাণ কমে যায়, তাই এর পরিবর্তে পানি, লেবুর পানি বা ভেষজ চা পান করতে পারেন।
৬. সুষম খাদ্যাভ্যাস মেনে চলুন
- পুষ্টিকর স্ন্যাকস রাখুন: অফিসে কাজের ফাঁকে হালকা ও স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস রাখুন, যেমন: বাদাম, ফল, দই ইত্যাদি। এটি ক্ষুধা মেটাবে এবং অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমাবে।
- নিয়মিত খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন: অস্বাস্থ্যকর ফাস্ট ফুড বা মিষ্টি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলুন। সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন যাতে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও খনিজ মেলে।
৭. আরামদায়ক চেয়ার এবং ডেস্ক ব্যবহার করুন
- এর্গোনমিক চেয়ার ও ডেস্ক: দীর্ঘ সময় বসে কাজ করতে হলে সঠিক উচ্চতা ও আরামদায়ক চেয়ার ব্যবহার করা জরুরি। এর্গোনমিক চেয়ার ও ডেস্ক পিঠের ব্যথা কমাতে এবং কাজের সময় আরাম প্রদান করতে সাহায্য করে।
- কী-বোর্ড ও মাউসের অবস্থান ঠিক রাখুন: আপনার হাত যেন আরামদায়ক অবস্থানে থাকে এবং মাউস ও কী-বোর্ড খুব দূরে না থাকে।
কাজের সময় শারীরিক ব্যায়ামের উদাহরণ
- ঘাড় স্ট্রেচ : ঘাড় ধীরে ধীরে ডান থেকে বামে এবং সামনে-পেছনে ঘোরান : ঘাড়ের পেশির চাপ দূর করবে
- কাঁধের রোল : কাঁধের পেশি শিথিল করতে কাঁধ ঘড়ির কাঁটার মতো এবং বিপরীত দিকে ঘোরান : কাঁধের চাপ কমাবে
- বসে লেগ স্ট্রেচ : চেয়ারে বসে এক পা সামনে সোজা করুন এবং কয়েক সেকেন্ড ধরে রাখুন, তারপর অন্য পায়ে করুন : পায়ের পেশি শক্তিশালী ও নমনীয় করবে
- গোঁড়ালি ঘোড়ানো : চেয়ারে বসে গোঁড়ালি ঘড়ির কাঁটার মতো ঘোরান : পায়ের পেশি ও জয়েন্টের চাপ কমাবে
অফিসে বসে দীর্ঘ সময় কাজ করার ফলে শরীরে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে, কিন্তু সঠিক অভ্যাস ও যত্নের মাধ্যমে এগুলো প্রতিরোধ করা সম্ভব। সঠিক ভঙ্গিমায় বসা, নিয়মিত বিরতি, হালকা ব্যায়াম, এবং সুষম খাদ্যাভ্যাস মেনে চললে অফিসে কাজের চাপ ও শারীরিক সমস্যা কমিয়ে সুস্থ জীবনযাপন সম্ভব। শারীরিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন এবং প্রতিদিন কিছু সময় নিজের জন্য ব্যয় করুন, যাতে শরীর সুস্থ থাকে এবং কর্মক্ষমতাও বৃদ্ধি পায়।